মাদক বা ড্রাগস হলো বিষধর সাপের মত যা প্রতিনিয়ত একজন সুস্থ ব্যক্তিকে ধীরে ধীরে নিঃশেষ করে দেয়।সমা বলতে মাদকের প্রতি আসক্তিকে জের সব বয়সি নারী-পুরুষের মধেই মাদকের আসক্তি দেখা যায়।তবে তরুন সমাজেই এর প্রভাব সবচেয়ে বেশী।এক পরিসংখ্যানে দেখা যায় আমাদের দেশে মাদকাসক্তদের মধে শতকরা ৭২ ভাগই হলো কিশোর এবং তরুন.

মাদকদ্রব্য এবং মাদকাসক্তি কি?

মাদকদ্রব্য হলো একটি ভেষজ দ্রব্য যা গ্রহনে মানুষের স্বাভাবিক শারীরিক ও মানসিক অবস্থার উপর প্রভাব পড়ে এবং যা আসক্তি সৃষ্টি করে।মাদকদ্রব্য বেদনানাশক কর্মের সাথে যুক্ত থাকে।মাদকের প্রভাবে তন্দ্রাচ্ছন্নতা,মেজাজ পরিবর্তন,মানসিক আচ্ছন্নতা,রক্তচাপ পরিবর্তন ইত্যাদি শারীরিক এবং মানসিক পরিবর্তন হয়।মূলকথা মাদক গ্রহনে ব্যক্তির central nervous system এ এক ধরনের পরিবর্তন দেখা দেয়,যার ফলে মাদকসেবনকারি ব্যক্তির শারিরীক ও মানসিক অনুভূতির এক ধরনের পরিবর্তন আসে যাকে তারা নেশা হিসাবে বিবেচনা করে।মাদক গ্রহন করলে মানুষের শারীরিক,মানুষিক অবস্থার ব্যাপক নেতিবাচক পরিবর্তন ঘটে এবং মাদক দ্রব্যের উপর নির্ভরশীলতা সৃষ্টির পাশাপাশি দ্রব্যটি গ্রহনের পরিমান ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে।ব্যাক্তির এই অবস্থাকে বলে মাদকাসক্তি এবং যে গ্রহন করে তাকে বলে মাদকাসক্ত।

মাদকাসক্তির কারন

  •  দলগত চাপ বা মাদকাসক্ত সঙ্গী সাথীদের প্রভাব ও প্রলোভন।
  •  মাদকদ্রব্যের প্রতি কৌতূহল,অজ্ঞতা,অসচেতনতা,মূল্যবোধের অবক্ষয় এবং নৈতিক ও ধর্মীয় শিক্ষার অভাব।
  •  পারিবারিক দ্বন্দ্ব,কলহ,অবিশ্বাস ও অশান্তি।
  •  দুর্বল ব্যক্তিত্ত্ব এবং মানসিক চাপ সহ্য করার ক্ষমতার অভাব
  •  পরিবারের অন্যদের মাদক গ্রহন,মাদক ব্যবসায় জড়িত থাকা
  •  পরিবারে অপসংস্কৃতির চর্চা এবং অভিভাবকের নীতিহীনতা
  •  অভিভাবকদের উদাসীনতা,অবহেলা,অতিশাসন কিংবা অতি আদর
  •  বিবাহ বিচ্ছেদ,বহু বিবাহ এবং পরিবার ভেঙ্গে যাওয়া
  •  অপরাধ সম্পৃক্তটা ও অবৈধ উপার্জন
  •  বংশগত প্রভাব ও ব্যক্তিবিশেষের বিশেষ জৈব রাসায়নিক অবস্থা
  •  মাদকের সহজ লভ্যতা

মাদকাসক্তির উপসর্গ ও মাদকাসক্তকে চেনার উপায়

আপনার সন্তান বা আপনার আপনজন মাদকাসক্ত কিনা তা কি করে বুঝবেন?মাদক গ্রহনের ফলে একজন ব্যক্তির শারীরিক এবং আচরনগত বেশ কিছু পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়,সেই পরিবর্তনগুলো দেখে বুঝে নিতে হবে আপনার সন্তান বা প্রিয়জন মাদক নিচ্ছে কিনা।

শারীরিক পরিবর্তন

  •  দ্রুত ওজন বেড়ে যাওয়া বা কমে যাওয়া
  •  চোখ লাল হয়ে থাকলে এবং চোখের মনি স্বাভাবিক এর চেয়ে বড় বা ছোট দেখালে
  •  পারিবারিক দ্বন্দ্ব,কলহ,অবিশ্বাস ও অশান্তি।
  •  নাক দিয়ে প্রায়ই রক্ত পরলে
  •  মুখে,পোশাকে বা শরীরে খারাপ গন্ধ পেলে
  •  চেহারার উজ্জ্বলতা নষ্ট হয়ে গেলে,চামড়ায় কালচে দাগ পড়লে আচরনগত পরিবর্তন
  •  যৌনক্রিয়ায় আনাগ্রহ এবং ক্ষমতা হ্রাস
  •  ক্লাস বা অফিসে যেতে না চাওয়া/না যাওয়া
  •  রাত জেগে থাকা,দিনে ঘুম
  •  লম্বা সময় ধরে ঘুম
  •  সহজেই উত্তেজিত হয়ে যাওয়া/অকারনে রেগে যাওয়া
  •  বাসা থেকে মূল্যবান জিনিস সরিয়ে ফেলা/চুরি করা
  •  ঘন ঘন টাকা চাওয়া/টাকার চাহিদা বেড়ে যাওয়া
  •  অতিরিক্ত মিষ্টি খেতে শুরু করা
  •  সহজে মারামারি করা/ঝগড়া করা
  •  সবসময় শরীরে ও রুমে পারফিউম/এয়ার ফ্রেশনার/সুগন্ধি ব্যবহার করা
  •  অকারনে সন্দেহ করা
  •  পরিবারে আশান্তি সৃষ্টি এবং ভাংচুর করা
  •  রাতে/ দিনে বাইরে বেশী সময় কাটানো
  •  মোবাইল,গেমস,টিভি,ইন্টারনেট ইত্যাদির প্রতি আসক্তি বেড়ে যাওয়া/রাত জেগে ব্যবহার করা
  •  মন খারাপ করে থাকা
  •  সামাজিক অনুষ্ঠানে না যাওয়া/যেতে না চাওয়া এছাড়াও কোন ব্যক্তির মাথার চুল,হাত-পায়ের লোম,মুখের লালা,রক্ত,ইউরিন টেষ্টের মাধ্যমে মাদকাসক্তি নির্ণয় করা যায়।

আমাদের দেশে সচরাচল যে সব মাদক দ্রব্য রয়েছে তার মধ্যে হিরোইন,কোকেন,ইয়াবা,আফিম,মারিজুয়ানজ/গাঁজা,ফেন্সিডিল,বিভিন্ন ধরনের ঘুমের ঔষধ,মদ,বিয়ার এমন কি জুতা লাগানোর আঠা পর্যন্ত দেখা যায়।অনেকে আবার বিভিন্ন ধরনের এনার্জি ড্রিংকের সাথে ঘুমের ঔষধ মিশিয়ে নেশা করে।

মাদকের কুফল সম্পর্কে বলে শেষ করা যাবে না।মাদক একজন ব্যক্তিকে বিভিন্ন ভাবে ক্ষতি সাধন করে থাকে। এবং এক সময় নিঃশেষ করে দেয়।

শারীরিক ও মানসিক ক্ষতিঃ

  • এইচআইভি/এইডস এ আক্রান্ত হতে পারে।
  • হেপাটাইটিস বি,হেপাটাইটিস সি তে আক্রান্ত হতে পারে।
  • ক্যান্সারে আক্রান্ত হতে পারে।
  • মস্তিস্ক বিকৃতি ঘটতে পারে।
  • মাদকাসক্ত ব্যাক্তির সন্তান অটিজম, ডাউন সিনড্রম, সিপি বা অন্যান্য অস্বাভাবিকতা নিয়ে জন্মানোর সম্ভাবনা থাকে।
  • স্মৃতিশক্তি হ্রাস পেতে পারে।
  • যৌনক্ষমতা হ্রাস পেতে পারে।
  • মহিলাদের বন্ধ্যাত্ব দেখা দিতে পারে।
  • অস্থিরতা দেখা দিতে পারে।
  • বিষন্নতায় ভুগতে পারে
  • আক্রমণাত্বক মনোভাব হয়ে যেতে পারে।
  • আত্নহত্যার প্রবণতা দেখা দিতে পারে।

পারিবারিক ক্ষতিঃ

  • পরিবারের শান্তি,সম্মান ও নিরাপত্তা নষ্ট হয়।
  • পরিবারের সদস্যদের সাথে সম্পর্ক নষ্ট হয়।
  • পরিবারের অন্য সদস্যদের মানসিক শান্তি নষ্ট হয়।
  • পারিবারিক ভাঙ্গন (বিবাহ বিচ্ছেদ) দেখা দেয়।
  • সন্তানদের মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয় এবং তাদের যথাযথ যত্ন নেয়ার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরী হয় ফলে তাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার হয়ে পরে।

আর্থিক ক্ষতিঃ

  • নিজে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং পরিবারের সদস্যদেরও আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
  • ব্যাপকভাবে সম্পদ ও অর্থ নষ্ট হয়।
  • ছাত্রজীবন,কর্মস্থল ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সফলতা বাধাগ্রস্থ হয়।

সামাজিক ক্ষতিঃ

  • সমাজে ঘৃনার পাত্র হিসেবে বিবেচিত হয়।
  • বিভিন্ন অপরাধের সাথে জড়িত হয়ে পড়ে।
  • সামাজিকভাবে মান-সম্মান হারাতে হয়।
  • সমাজ কর্তৃক পরিত্যক্ত হতে হয়।
  • বিভিন্ন ধরনের সামাজিক বৈষম্যের শিকার হয়।
  • সমাজে অপরাধমূলক কর্মকান্ডের বিস্তার ঘটে।

মাদকের প্রভাবে গর্ভকালীন জটিলতা ও সন্তানের উপর মাদকের প্রভাবঃ

  • গর্ভপাত হয়ে যাবার সম্ভবনা থাকে।
  • নির্ধারিত সময়ের পূর্বেই বাচ্চা প্রসব হতে পারে।
  • বাচ্চা বিকলাঙ্গ হতে পারে এবং বাচ্চার হৃদপিণ্ডে এবং শ্বাসপ্রশ্বাসে সমস্যা হতে পারে।
  • বাচ্চা মানসিক প্রতিবন্ধী হতে পারে।
  • নেশার কারনে মা-বাবার কাছ থেকে বিভিন্ন ধরনের রোগ (যেমনঃ এইচআইভি/এইডস,হেপাটাইটিস) বাচ্চার মধ্যে সংক্রমিত হতে পারে।
  • বাচ্চার মধ্যেও মাদকের নির্ভশীলতা আসতে পারে।

মাদকের অভিশাপ থেকে মুক্তির উপায়

  •  পরিবারের কেউ যাতে মাদকদ্রব্যের সাথে জড়িয়ে পড়তে না পারে সে ব্যাপারে সর্বদা সতর্ক থাকতে হবে।
  •  পারিবারিক বন্ধন শক্তিশালী করা,কাজের ফাঁকে ফাঁকে সন্তানদের সময় দেয়া,তাদের নিয়মিত খোঁজ-খবর নেয়া,তাদের বই পড়া,খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড ও সুস্থ বিনোদন ব্যবস্থা করা।
  •  সন্তানের সামনে স্বামী-স্ত্রী বিরোধ না করা,নিজেরা সংযত জীবনযাপন এবং সন্তানদের ছোটবেলা থেকে সংযত জীবন যাপনের নৈতিক শিক্ষা দেয়া।পরিবারে ধর্মীয় মূল্যবোধ এবং ধর্মীয় অনুশাসনের বিকাশ ঘটানো।
  •  পরিবারে কোন মাদকাসক্ত ব্যক্তি থাকলে তাকে অপরাধী না ভেবে এবং তার প্রতি ঘৃণা প্রকাশ কিংবা তাকে উপেক্ষা না করে বরং একজন অসুস্থ্য ব্যক্তি হিসেবে সাহায্য ও ভালবাসার হাত বাড়িয়ে দ্রুত তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করা।
  •  সন্তানের সামনে ধূমপান বা নেশা না করা,ধূমপান বা নেশার উপকরণের ব্যাপারে সন্তানের কোন স্বাভাবিক অনুসন্ধিৎসাকে উপযুক্ত ব্যাখ্যা এবং জবাবের মাধ্যমে নিবৃত করা এবং এর কুফল সম্পর্কে তাকে বুঝানো।
  •  সন্তানের চালচলন,কথাবার্তা,অন্যের সাথে মেলামেশা,ঘরের বাইরে যাওয়া এবং সময়মত ফিরে আসা,খাওয়া-দাওয়া,মেজাজ,আচরণ,অভ্যাস ইত্যাদি সম্পর্কে গভীরভাবে পর্যবেক্ষন করতে হবে।সন্দেহজনক কিছু দেখলে সে সম্পর্কে খোঁজ নিতে হবে।
  •  সন্তানকে অতি শাসন বা অতিআদর করা এবং যুক্তিসঙ্গত কারন ছাড়া সন্তানের হাতে টাকা পয়সা দেয়া উচিত নয়।কোন কাজে সন্তানের অসফলতায় শাস্তি নয়,সান্তনা ও পরামর্শের হাত বাড়িয়ে দিতে হবে।
  •  সন্তান একরোখা,স্বেচ্ছাচারী,জেদী,কলহপ্রবণ,মারমুখী কিংবা দূর্বল ব্যক্তিত্বের অধিকারী হলে শৈশবেই তার মনস্তাত্বিক বিকাশের চেষ্টা করা এবং তাকে আত্ববিশ্বাসি,সচেতন ও সুস্থ্য শিশু হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।নতুবা বড় হলে সহজেই অন্যের প্রভাবে মাদকাসক্ত হতে পারর্ম
  •  মাদক অপরাধ দমনের যেকোন কাজে সরকারী বা বেসরকারী সংস্থাকে সাহায্য করা
  •  অবৈধ মাদকদ্রব্য বিক্রি বা চোরাচালান হতে দেখলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাকে খবর দেয়া
  •  পাড়ায় পাড়ায় অবৈধ মাদক ক্রয়-বিক্রয় বা ব্যবহারের বিরুদ্ধে গনপ্রতিরোধ গড়ে তোলা।মাদকাসক্তি একটি সামাজিক সমস্যা,এটি একটি সামাজিক ব্যাধি।সামাজিক আন্দোলনের মাধ্যমেই,একে নির্মূল করা সম্ভব।